ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে দারিদ্র্যকে জাদুঘরে পাঠাবার মুহাম্মদ ইউনূসের জনসমাদরমূলক বাগাড়ম্বরকে লুফে নিয়েছিল সারাবিশ্বের গণমাধ্যম, রক্ষণশীল ঘরনার চিন্তাশালাগুলো আর পণ্ডিতরা। বিজ্ঞাপনী গমকের প্রতারণাতুল্য বাস্তবতাবর্জিত একথার মধ্যে আসলে ছিল নয়া-উদারবাদী ব্যবস্থার সাথে মিল রেখে ক্ষুদ্রঋণের প্রসারে জোরেসোরে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা আদায়, উন্নত দেশগুলোর বৈদেশিক সাহায্যের ধারা পরিবর্তনে সহায়ক পরিবেশ রচনা এবং বড় বড় লগ্নীকারীকে প্রতিষ্ঠানকে ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দরিদ্রদের মাঝে চড়া মুনাফায় অর্থ লগ্নী এবং তাদের কাছে প্রযুক্তি/পণ্য/সেবা বিক্রির (জুতা, দই, সেল ফোন, পানীয়জল ও সোলার প্যানেল উল্লেখ্য) সম্ভাবনার দরজা চিনিয়ে দেয়া।
তাঁর ঘোষিত--‘দারিদ্র্য কী তা বুঝতে জাদুঘরে যেতে হবে’--সে দিবাস্বপ্নের ঘোর কেটে যাবে সাম্প্রতিক কিছু পরিসংখ্যান থেকে। জাতিসংঘ উন্নয়ন তহবিলের ১৯৯০ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের ৮৪% মানুষের বাস ছিল দারিদ্র্যরেখার নিচে। ১৯ বছর পর, ২০০৯ সালের প্রতিবেদন বলছে বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৮০% দৈনিক আয় দিনে দুই মার্কিন ডলারের কম। গত বছর বিশ্ব জুড়ে খাদ্যদ্রব্যের দাম ২৯% বৃদ্ধির ফলে ২০১০ সালের জুন মাস থেকে নতুন করে চার কোটি ৪০ লাখ মানুষ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে পতিত হয়েছে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন। এ বছরের জানুয়ারি মাসে খাদ্যদ্রব্যের দাম আরো এক দফা বৃদ্ধি পেয়ে বিগত ৩০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। গত বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘ফিডিং আমেরিকা’ নামক অনাহারীদের খাবার দানকারী একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান তিন কোটি ৭০ লাখ মানুষকে খাবার দিয়েছে, যে সংখ্যা ২০০৬ সালের তুলনায় ৪৬% বেশি। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ২০১০ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী পৃথিবীতে সাড়ে ৯২ কোটি মানুষ দিনে ৭০ টাকা বা এক ডলারের উপার্জন নিয়ে চরম দারিদ্র্যে নিপতিত অবস্থায় বেঁচে আছে। প্রতিবেশী ভারতে যেখানে গত দু’ দশকে ৩০০০ ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান হাজার-হাজার গ্রামে তাদের ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করেছে, সেখানে দেনার দায় আর দারিদ্র্যের ছোবলে আত্মঘাতী হয়েছে ১০০,০০০ কৃষক। গত বছরের মার্চ থেকে নভেম্বরে শুধু অন্ধ্র প্রদেশে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর জুলুমে আত্মহত্যা করেছেন ৮০ জন দরিদ্র ঋণগ্রহীতা নারী-পুরুষ।
ক্ষুদ্রঋণের সাফল্য নিয়ে মার্কিন অর্থনীতিবিদ রবার্ট পলিনের বক্তব্য হচ্ছে: ‘ক্ষুদ্রঋণের সাফল্যের কথা বলতে গিয়ে বাংলাদেশ আর বলিভিয়ার কথা ফলাওভাবে উল্লেখ করা হলেও, এখনও এ দুটি দেশই পৃথিবীর দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম।’
এ পর্যন্ত ৭০০০ কোটি ডলারের বাণিজ্যিক পুঁজি দিয়ে গড়া বিশ্বব্যাপী ক্ষুদ্রঋণ খাতের ব্যাপক প্রসারের মাধ্যমে ২০০৯ সালের মধ্যে সারা বিশ্বে ১২ কোটি ৮০ লাখ মানুষ এর আওতায় এলেও তা দিয়ে অতি সহজেই দারিদ্র্য দূর করা যাবে, তেমন কোনো প্রমাণ কোথাও পাওয়া যায়নি। বরং চলমান পদ্ধতির ক্ষুদ্রঋণ বিভিন্ন দেশে সৃষ্টি করেছে নির্মমভাবে সুদ (কোনো কোনো দেশে ২২৫% পর্যন্ত) আদায়ের মাধ্যমে দরিদ্রদের স্থায়ী ঋণজালে আটকানো, সামাজিক অশান্তি, ঋণগ্রহীতাদের আত্মহনন ও বাস্তুচ্যুতির মতো নির্মম সব ঘটনাবলী। বিভিন্ন মাত্রায় বাংলাদেশেও এসব ঘটনার বিপুল আলামত আছে।
বাংলাদেশে ৩৫ বছর ধরে ক্ষুদ্রঋণ পরিচালনার ফলাফলের উপরোক্ত হালকেই প্রশ্ন করেছেন ডেনিশ অনুসন্ধানী সাংবাদিক টম হাইনম্যান তাঁর প্রামাণ্যচিত্র ‘দি মাইক্রো ডেট’ এ। টম তাঁর প্রামাণ্যচিত্রে বৈশ্বিক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ক্ষুদ্রঋণের কার্যকারিতাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। তাঁর প্রামাণ্যচিত্রে প্রাসঙ্গিকভাবে ৭০০ কোটি টাকার বৈদেশিক সাহায্যের অর্থ নিয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের অনিয়মের গোপন তথ্য ফাঁস হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ সরকার তহবিল নিয়ে অনিয়মসহ গ্রামীণ ব্যাংকের অন্যান্য বিষয় তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নেয় বিগত ৬ ডিসেম্বর। সে সময় পর্তুগালে অবস্থানরত ড. মুহাম্মদ ইউনূস যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সেই তদন্তকে স্বাগত জানিয়ে সংবাদমাধ্যমের উত্তেজনাকে প্রশমিত করে বলেছিলেন যে, তদন্তের মাধ্যমে জনগণের সামনে সত্য উদঘাটিত হয়ে বিষয়টির নিষ্পত্তি ঘটবে।
কিন্তু, দুর্নীতির বিরোধিতা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা, জানার অধিকার, প্রভৃতি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সরব মু. ইউনূসের প্রকৃত রূপ বেরিয়ে আসতে শুরু করে সরকারি তদন্ত প্রক্রিয়া শুরু হবার পর থেকেই। তিনি তাঁর সংযোগ ও প্রভাব ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম দ্বারা প্রচারণা শুরু করেন যে, সরকারি তদন্ত আসলে তার বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত ঈর্ষা ও বিদ্বেষপ্রসূত এবং গ্রামীণ ব্যাংককে দখল করে নির্বাচনের কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে পরিচালিত হচ্ছে। গণমাধ্যম থেকে শুরু করে তার রাজা-রানী-প্রেসিডেন্ট-ফার্স্ট লেডি বন্ধুদের দল সক্রিয় হয়ে ওঠে এই তদন্ত বন্ধ করার জন্য। নরওয়ের নোবেল কমিটিও এক অভিনব ও বিরল চারিত্রিক সনদ নিয়ে হাজির হয় মাঠে।
আলফ্রেড নোবেলের জীবিতাবস্থায় এই পুরস্কার প্রবর্তনের সময় থেকে বিগত ১১০ বছরে পদকপ্রাপ্ত কারো জন্য নোবেল কমিটির (নো.ক.) কোনো বিবৃতি বা চারিত্রিক সনদ দেবার ইতিহাস নেই। নো.ক. এক্ষেত্রে ইতিহাস গড়েছে ড. ইউনূসকে নিয়ে। ইউনূসের ক্ষেত্রে নো.ক. দু’বার এমন অভিনব কাণ্ড করল। নোবেল পুরস্কার থেকে প্রাপ্ত অর্থের উপর আয়কর না দেবার জন্য ইউনূস নো.ক.এর কাছ থেকে চিঠি আনিয়েছিলেন। সরকারি সুবিধা নেয়ায় উদারচিত্তের ইউনূসের কর প্রদানে সহজাত যে অনুদারতা আছে, তাতে মদত দিয়েছিল নোবেল কমিটি। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল বাংলাদেশের কোষাগার তথা গরিব মানুষরা।
দরিদ্র নারীদের রক্ত নিঙরানো টাকায় নির্মিত গ্রামীণ ব্যাংক ভবনের ১১,০০০ বর্গফুটের জন্য মাসিক এক টাকা ভাড়া প্রদানকারী ‘ইউনূস সেন্টার’ থেকে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে আসা বিবৃতিটি দেখে সঙ্গতভাবে অনুমান করা যায় যে, বাংলাদেশে জনমত গঠন এবং সরকারের উপর চাপ সৃষ্টির জন্যই বিবৃতিটি পরিকল্পিতভাবে আবির্ভূত হয়েছে নো.ক. ও ইউনূসের ভাবমূর্তি রক্ষার প্রচারণার অংশ হিসেবে।
সাফাই গাওয়া বিবৃতিটি নিজেই এর অন্তর্নিহিত দুর্বলতা ফাঁস করে বলেছে নরওয়ের টেলিভিশনে প্রচারিত প্রামাণ্যচিত্র ‘ক্ষুদ্র ঋণের জালে’ এবং বাংলাদেশে প্রকাশিত নানা সংবাদে কিছু অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নো.ক. তাদের অবস্থান জানাচ্ছে : নোবেল পুরস্কার দেবার আগে যে ধরনের যাচাইবাছাই করা হয় ‘তার চেয়ে অনেক বেশি পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে’ গ্রামীণ ব্যাংক ও ইউনূসকে পুরস্কার দেবার আগে। ইউনূসকে নোবেল পুরস্কার দেয়া নিয়ে প্রামাণ্যচিত্রে কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত না হলেও বা এ নিয়ে কারো কোনো সংশয়-উৎকণ্ঠা প্রকাশের আগেই ‘ঠাকুর ঘরে কে রে? আমি তো কলা খাইনি’ ধারায় নো.ক. অগ্রিম আশ্বস্ত করেছে সবাইকে। কিন্তু, বিবৃতিটির একটি লাইন উদ্বিগ্ন ও কৌতূহলী করে তুলবে এর উদ্দেশ্য ও নৈতিক মানদণ্ড নিয়ে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে ‘যখন একটি ব্যাংকের ৭০ থেকে ৮০ লাখ ঋণগ্রহীতা থাকে, তখন তার মধ্যে কিছু নেতিবাচক উদাহরণ পাওয়া যেতে পারে।’ এই বাক্যটির মধ্যে গুরুতর ও ভয়ানক কয়েকটি দিক রয়েছে : ১. নো.ক. প্রকারন্তরে স্বীকার করছে যে ‘কিছু নেতিবাচক উদাহরণ’ আছে ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষেত্রে । সেক্ষেত্রে তাদের ‘অনেক বেশি পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত নেয়া’র ফল কী দাঁড়ালো? তারা অনিয়ম জর্জরিত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কৃত করে কি বিশ্ববাসীকে ধোঁকা দিল? ২. তাদের কথায় মনে হচ্ছে নেতিবাচক উদাহরণের দায়দায়িত্ব যেন ৭০-৮০ লাখ দরিদ্র ঋণগ্রহীতার। কিন্তু, বৈদেশিক সাহায্য নিয়ে যে অনিয়মের অভিযোগ প্রামাণ্যচিত্রে এবং পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের সাংবাদমাধ্যমে এসেছে (নিজ পারিবারের ব্যবসার সাথে গ্রামীণ প্রধানের ব্যবসায়িক চুক্তি করা ও ঋণ দেয়াসহ অন্যান্য অনিয়ম) তার দায়দায়িত্ব কী দরিদ্র ঋণগ্রহীতাদের, নাকি ইউনূসসহ গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনাকারীদের? যাচাই-বাছাই করার সময় তারা কি তত্ত্বাবধানকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিট রিপোর্ট এবং সংশ্লিষ্ট দাতাসংস্থাগুলোর দলিলপত্র দেখেছিলেন? যদি দেখে থাকেন, তবে তাদের দেশের মহাফেজখানায় রক্ষিত ‘কনফিডেন্সিয়াল’ ছাপমারা দলিলদস্তাবেজের ভিত্তিতে আনীত অভিযোগের হদিশ নো.ক. কেন পেল না? নরওয়ের করদাতাদের অর্থ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা একটি ব্যক্তিকে তারা কী দেখে এই খেতাবে ভূষিত করল? নিজ দেশের মানুষের প্রতি নো.ক.র দায়বদ্ধতার যেখানে এই হাল, সেখানে বাংলাদেশের মানুষের প্রতি তারা কতটুকু শ্রদ্ধা ও দায়বদ্ধতা থেকে এই বিবৃতি দিচ্ছে সে প্রশ্ন তোলা কি যুক্তিসঙ্গত নয়? ৩. এই সাফাইমূলক বিবৃতি দেবার মাধ্যমে নো.ক. আসলে বাংলাদেশ সরকারের তদন্ত প্রক্রিয়াকে এবং সাধারণ জনগণকে বিভ্রান্ত করতে জড়িয়ে পড়েছে বলে যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত টেনে বলা যায় তারা নিজেদের ব্যর্থতা বা পরিকল্পিত ভূমিকা ঢাকতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেছে।
বিগত কয়েক মাসে ড. ইউনূসের মর্যাদা রক্ষায় আস্তে-আস্তে মঞ্চে হাজির হতে থাকে দেশের ভিতরের ও বাইরের আরো অনেক কুশীলবরা। বাংলাদেশের মানুষ আর সরকারকে দুর্নীতি দমনে পরামর্শদাতা বিশ্বব্যাংকসহ কিছু বিদেশী দূতাবাস বিশেষভাবে তৎপর হয়ে ওঠে সরকারের উপর চাপ প্রয়োগে। শেখ হাসিনাকে হিলারি ক্লিন্টন ফোন করেন ইউনূসকে রক্ষার জন্য। অন্যতম নেতৃস্থানীয় ও ব্যয়বহুল জনসংযোগ ও লবিস্ট ফার্ম বার্সন-মারসটেলরকে নিয়োগ দেয়া হয় আন্তর্জাতিক প্রচারণা ও লবি করার জন্য। এদের উদ্যোগে আয়ারল্যান্ডের সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান মেরি রবিনসনের নেতৃত্বে ‘ফ্রেন্ডস অফ ইউনূস’ নামের সংগঠন গড়ে ওঠে মুহাম্মদ ইউনূস এর মর্যাদা রক্ষার জন্য। অন্যদিকে ইউনূসকে কেলেঙ্কারি, তদন্ত আর বরখাস্ত হবার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য বিরামহীন তৎপরতা চলতে থাকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে।
মার্চ মাসের প্রথমাংশে বাংলাদেশ ব্যাংক ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে অপসারিত করার পর ইউনূসকে রক্ষার জন্য বিশেষ করে মার্কিন তৎপরতা এক অভূতপূর্ব নবমাত্রা লাভ করে। অপসারণের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রথমে ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত তার দেশের পক্ষ থেকে আপত্তিকরভাবে প্রচণ্ড ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ইউনূসকে রক্ষার বিষয়ে মার্কিন তৎপরতা এখানেই থেমে থাকেনি। একক ও যৌথভাবে মার্কিন সিনেটর ও কংগ্রেস সদস্যরা ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন বাংলাদেশের উপর। মার্চ মাসের শেষাংশে এই চাপ প্রয়োগ প্রকাশ্য হুমকিতে রূপ নেয় আমেরিকার দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফরকালে এবং তৎপরবর্তী সময়ে মার্কিন কংগ্রেসে দেয়া বক্তব্যের মাধ্যমে।
পুঁজিবাদী দুনিয়ার গণমাধ্যম ও কর্তাব্যক্তিদের প্রায় চার মাসাধিককাল ধরে চলমান এই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাই ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে কেন্দ্র করে একমাত্র বিরল ও অতুলনীয় ঘটনা নয়। ইউনূসকে কেন্দ্র করে বরাবরই বিরাজ করেছে অতুলনীয়, বিরল ও অভূতপূর্ব সব প্রবণতা ও প্রপঞ্চ। বিগত প্রায় আড়াই দশক ধরে খ্যাত-অখ্যাত নানা প্রতিষ্ঠান থেকে (ভেনেজুয়েলার সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মানসহ। হুগো চাভেজও ইউনূসের মর্মার্থ বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন।) শতাধিক পদক, খেতাব ও ডিগ্রী পেয়ে এক বিশ্ব রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন তিনি। সারা বিশ্বের সংবাদমাধ্যম ও মূলধারা উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা সর্বদা তাঁকে নিয়ে ব্যস্ত। এসবের মাধ্যমে অতিযত্নে তাঁকে পরিণত করা হয়েছে বিশ্ব আইকন হিসেবে। অর্থাৎ, তাঁর ব্যক্তি ইমেজের মাধ্যমে ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে দারিদ্র্যকে ইতিহাসে পরিণত করার এক কল্পকাহিনীকে বিশ্বাস করানোর মহাযজ্ঞ ঘটানো হয়েছে বিগত দু’ দশকেরও বেশি সময় ধরে।
গত শতাব্দীর ৬০ এর দশকে ‘সবুজ বিপ্লব’ এর স্বর্ণযুসহ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধত্তোরকাল থেকে আর কোনো বুর্জোয়া উন্নয়ন-পন্থা নিয়ে এত ঢাকঢোল পেটানো হয়নি; যা করা হয়েছে মু. ইউনূস প্রবর্তিত ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে। ক্ষুদ্রঋণ নামক এই উন্নয়ন-পন্থা নিয়ে এত ব্যাপক উৎসাহের কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে এটি প্রবর্তিত হবার সময়ের বৈশিষ্ট্য (স্মতর্ব্য ৮০র দশক থেকে নয়া-উদারবাদের ক্রম উত্থান); এ পন্থার মধ্যে লাভজনকভাবে দরিদ্রদের কাছে পুঁজি লগ্নী করার ক্রম প্রকাশ্য সম্ভাবনা এবং সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার অবসানকালে তৃতীয় বিশ্বে উন্নত দেশগুলোর উন্নয়ন সাহায্য নীতিকাঠামোর ক্রমশ নয়া-উদারবাদী পন্থার দিকে সরে যাবার ক্ষেত্র প্রস্তুতের সহায়ক হিসেবে এর ভূমিকা এই উন্নয়ন-পন্থাকে পুঁজিবাদী বিশ্বে জনপ্রিয় ও তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছিল। সব দিক থেকে ক্ষুদ্রঋণ হয়ে উঠেছিল একটি আদর্শ পুঁজিবাদী উন্নয়ন-পন্থা -- উন্নত বিশ্বের নয়নের মণি। এর মতাদর্শগত দিকটিও ছিল নয়া-উদারবাদের সঙ্গে যুতসইভাবে সঙ্গতিপূর্ণ; অবয়বে ছিল চোখে তাক লাগানো দরিদপ্রেমী চটক। সব মিলিয়ে এটি ছিল ‘ইতিহাসের অবসানে’র যুগে মানবিক চেহারাসম্পন্ন একটি আদর্শ পুঁজিবাদী উন্নয়ন-পণ্য।
বহুল বিক্রিত সেই লাভজনক উন্নয়ন-পণ্যটির কার্যকারিতা ও গুণাগুণ আজ যখন ক্রমশ প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে উঠছিল, সেই ধীরগতির প্রক্রিয়ায় বর্তমান ইউনূসকাণ্ড নানা দিক থেকে একটি বড় গতি সঞ্চার করেছে। প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে এই উন্নয়ন-পন্থার কার্যকারিতা ও অন্তঃসারশূণ্যতাকে। অন্তঃসারশূণ্য উন্নয়ন-পণ্যের মুখের মেকি রঙ যখন খসে পড়ছে, তখন বিব্রত হয়ে পড়ছে এই নাটকের প্রকৃত রূপসজ্জাকাররা। কাজেই মুহাম্মদ ইউনূসের ব্যক্তিগত সম্মান নিয়ে এই রূপসজ্জাকার হইচই তুললেও, আসলে তারা বিব্রত হচ্ছে নিজেদের উন্নয়ন-পন্থাটির আসন্ন মুখ থুবড়ে পড়া নিয়ে। ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে দারিদ্র্যকে জাদুঘরে পাঠাবার বাগাড়ম্বরের আশু ব্যর্থতার আশংকায় আর নিজেদের ইজ্জতহানী নিয়েই প্রকৃতপক্ষে তাদের এত উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা।
সহায়ক সূত্র:
১. ‘মাইক্রো-ফাইন্যান্স ইন্ড্রাস্টি ‘ব্লাড সাকারস’ এনকাউন্টার গ্লোবাল হোস্টিলিটি’। ইকোনমি ওয়াচ। ১.২.১১
২. ‘ওয়ার্ল্ড ব্যাংক : ফুড প্রাইসেস এ্যাট ‘ডেঞ্জারাস লেভেল’’। সিবিএস বিজনেস নিউজ। ১৫.২.১১
৩. ‘অ্যাজ ফুড প্রাইস রাইজ, সাসটেইনিবিলিটি মেকস মোর সেন্স’। দি ডেইলি স্টার। ওয়ানওনটা, নিউ ইয়র্ক।২৬.২.১১
৪. ‘মাইক্রো ক্রেডিট ক্রিটিকস সে ডেট ডাজনট ইকোয়াল ইমানসিপেশন’। কানাইয়া ডি’আলমেইদা। আইপিএস নিউজ। ২৪.২.১১
৫. স্টেট অফ দি মাইক্রোক্রেডিট সামিট ক্যাম্পেইন রিপোর্ট। মার্চ ২০১১
----------------------
নিবন্ধটি 'সংস্কৃতি' (এপ্রিল ২০১১) পত্রিকাতে প্রকাশিত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন