বৃহস্পতিবার, ৭ জুলাই, ২০১১
বৃহস্পতিবার, ৫ মে, ২০১১
ড. ইউনূসের সম্মান : ব্যক্তি না উন্নয়ন-পন্থার মর্যাদা রক্ষার প্রশ্ন?
ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে দারিদ্র্যকে জাদুঘরে পাঠাবার মুহাম্মদ ইউনূসের জনসমাদরমূলক বাগাড়ম্বরকে লুফে নিয়েছিল সারাবিশ্বের গণমাধ্যম, রক্ষণশীল ঘরনার চিন্তাশালাগুলো আর পণ্ডিতরা। বিজ্ঞাপনী গমকের প্রতারণাতুল্য বাস্তবতাবর্জিত একথার মধ্যে আসলে ছিল নয়া-উদারবাদী ব্যবস্থার সাথে মিল রেখে ক্ষুদ্রঋণের প্রসারে জোরেসোরে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা আদায়, উন্নত দেশগুলোর বৈদেশিক সাহায্যের ধারা পরিবর্তনে সহায়ক পরিবেশ রচনা এবং বড় বড় লগ্নীকারীকে প্রতিষ্ঠানকে ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দরিদ্রদের মাঝে চড়া মুনাফায় অর্থ লগ্নী এবং তাদের কাছে প্রযুক্তি/পণ্য/সেবা বিক্রির (জুতা, দই, সেল ফোন, পানীয়জল ও সোলার প্যানেল উল্লেখ্য) সম্ভাবনার দরজা চিনিয়ে দেয়া।
তাঁর ঘোষিত--‘দারিদ্র্য কী তা বুঝতে জাদুঘরে যেতে হবে’--সে দিবাস্বপ্নের ঘোর কেটে যাবে সাম্প্রতিক কিছু পরিসংখ্যান থেকে। জাতিসংঘ উন্নয়ন তহবিলের ১৯৯০ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের ৮৪% মানুষের বাস ছিল দারিদ্র্যরেখার নিচে। ১৯ বছর পর, ২০০৯ সালের প্রতিবেদন বলছে বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৮০% দৈনিক আয় দিনে দুই মার্কিন ডলারের কম। গত বছর বিশ্ব জুড়ে খাদ্যদ্রব্যের দাম ২৯% বৃদ্ধির ফলে ২০১০ সালের জুন মাস থেকে নতুন করে চার কোটি ৪০ লাখ মানুষ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে পতিত হয়েছে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন। এ বছরের জানুয়ারি মাসে খাদ্যদ্রব্যের দাম আরো এক দফা বৃদ্ধি পেয়ে বিগত ৩০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। গত বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘ফিডিং আমেরিকা’ নামক অনাহারীদের খাবার দানকারী একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান তিন কোটি ৭০ লাখ মানুষকে খাবার দিয়েছে, যে সংখ্যা ২০০৬ সালের তুলনায় ৪৬% বেশি। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ২০১০ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী পৃথিবীতে সাড়ে ৯২ কোটি মানুষ দিনে ৭০ টাকা বা এক ডলারের উপার্জন নিয়ে চরম দারিদ্র্যে নিপতিত অবস্থায় বেঁচে আছে। প্রতিবেশী ভারতে যেখানে গত দু’ দশকে ৩০০০ ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান হাজার-হাজার গ্রামে তাদের ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করেছে, সেখানে দেনার দায় আর দারিদ্র্যের ছোবলে আত্মঘাতী হয়েছে ১০০,০০০ কৃষক। গত বছরের মার্চ থেকে নভেম্বরে শুধু অন্ধ্র প্রদেশে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর জুলুমে আত্মহত্যা করেছেন ৮০ জন দরিদ্র ঋণগ্রহীতা নারী-পুরুষ।
ক্ষুদ্রঋণের সাফল্য নিয়ে মার্কিন অর্থনীতিবিদ রবার্ট পলিনের বক্তব্য হচ্ছে: ‘ক্ষুদ্রঋণের সাফল্যের কথা বলতে গিয়ে বাংলাদেশ আর বলিভিয়ার কথা ফলাওভাবে উল্লেখ করা হলেও, এখনও এ দুটি দেশই পৃথিবীর দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম।’
এ পর্যন্ত ৭০০০ কোটি ডলারের বাণিজ্যিক পুঁজি দিয়ে গড়া বিশ্বব্যাপী ক্ষুদ্রঋণ খাতের ব্যাপক প্রসারের মাধ্যমে ২০০৯ সালের মধ্যে সারা বিশ্বে ১২ কোটি ৮০ লাখ মানুষ এর আওতায় এলেও তা দিয়ে অতি সহজেই দারিদ্র্য দূর করা যাবে, তেমন কোনো প্রমাণ কোথাও পাওয়া যায়নি। বরং চলমান পদ্ধতির ক্ষুদ্রঋণ বিভিন্ন দেশে সৃষ্টি করেছে নির্মমভাবে সুদ (কোনো কোনো দেশে ২২৫% পর্যন্ত) আদায়ের মাধ্যমে দরিদ্রদের স্থায়ী ঋণজালে আটকানো, সামাজিক অশান্তি, ঋণগ্রহীতাদের আত্মহনন ও বাস্তুচ্যুতির মতো নির্মম সব ঘটনাবলী। বিভিন্ন মাত্রায় বাংলাদেশেও এসব ঘটনার বিপুল আলামত আছে।
বাংলাদেশে ৩৫ বছর ধরে ক্ষুদ্রঋণ পরিচালনার ফলাফলের উপরোক্ত হালকেই প্রশ্ন করেছেন ডেনিশ অনুসন্ধানী সাংবাদিক টম হাইনম্যান তাঁর প্রামাণ্যচিত্র ‘দি মাইক্রো ডেট’ এ। টম তাঁর প্রামাণ্যচিত্রে বৈশ্বিক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ক্ষুদ্রঋণের কার্যকারিতাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। তাঁর প্রামাণ্যচিত্রে প্রাসঙ্গিকভাবে ৭০০ কোটি টাকার বৈদেশিক সাহায্যের অর্থ নিয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের অনিয়মের গোপন তথ্য ফাঁস হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ সরকার তহবিল নিয়ে অনিয়মসহ গ্রামীণ ব্যাংকের অন্যান্য বিষয় তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নেয় বিগত ৬ ডিসেম্বর। সে সময় পর্তুগালে অবস্থানরত ড. মুহাম্মদ ইউনূস যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সেই তদন্তকে স্বাগত জানিয়ে সংবাদমাধ্যমের উত্তেজনাকে প্রশমিত করে বলেছিলেন যে, তদন্তের মাধ্যমে জনগণের সামনে সত্য উদঘাটিত হয়ে বিষয়টির নিষ্পত্তি ঘটবে।
কিন্তু, দুর্নীতির বিরোধিতা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা, জানার অধিকার, প্রভৃতি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সরব মু. ইউনূসের প্রকৃত রূপ বেরিয়ে আসতে শুরু করে সরকারি তদন্ত প্রক্রিয়া শুরু হবার পর থেকেই। তিনি তাঁর সংযোগ ও প্রভাব ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম দ্বারা প্রচারণা শুরু করেন যে, সরকারি তদন্ত আসলে তার বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত ঈর্ষা ও বিদ্বেষপ্রসূত এবং গ্রামীণ ব্যাংককে দখল করে নির্বাচনের কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে পরিচালিত হচ্ছে। গণমাধ্যম থেকে শুরু করে তার রাজা-রানী-প্রেসিডেন্ট-ফার্স্ট লেডি বন্ধুদের দল সক্রিয় হয়ে ওঠে এই তদন্ত বন্ধ করার জন্য। নরওয়ের নোবেল কমিটিও এক অভিনব ও বিরল চারিত্রিক সনদ নিয়ে হাজির হয় মাঠে।
আলফ্রেড নোবেলের জীবিতাবস্থায় এই পুরস্কার প্রবর্তনের সময় থেকে বিগত ১১০ বছরে পদকপ্রাপ্ত কারো জন্য নোবেল কমিটির (নো.ক.) কোনো বিবৃতি বা চারিত্রিক সনদ দেবার ইতিহাস নেই। নো.ক. এক্ষেত্রে ইতিহাস গড়েছে ড. ইউনূসকে নিয়ে। ইউনূসের ক্ষেত্রে নো.ক. দু’বার এমন অভিনব কাণ্ড করল। নোবেল পুরস্কার থেকে প্রাপ্ত অর্থের উপর আয়কর না দেবার জন্য ইউনূস নো.ক.এর কাছ থেকে চিঠি আনিয়েছিলেন। সরকারি সুবিধা নেয়ায় উদারচিত্তের ইউনূসের কর প্রদানে সহজাত যে অনুদারতা আছে, তাতে মদত দিয়েছিল নোবেল কমিটি। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল বাংলাদেশের কোষাগার তথা গরিব মানুষরা।
দরিদ্র নারীদের রক্ত নিঙরানো টাকায় নির্মিত গ্রামীণ ব্যাংক ভবনের ১১,০০০ বর্গফুটের জন্য মাসিক এক টাকা ভাড়া প্রদানকারী ‘ইউনূস সেন্টার’ থেকে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে আসা বিবৃতিটি দেখে সঙ্গতভাবে অনুমান করা যায় যে, বাংলাদেশে জনমত গঠন এবং সরকারের উপর চাপ সৃষ্টির জন্যই বিবৃতিটি পরিকল্পিতভাবে আবির্ভূত হয়েছে নো.ক. ও ইউনূসের ভাবমূর্তি রক্ষার প্রচারণার অংশ হিসেবে।
সাফাই গাওয়া বিবৃতিটি নিজেই এর অন্তর্নিহিত দুর্বলতা ফাঁস করে বলেছে নরওয়ের টেলিভিশনে প্রচারিত প্রামাণ্যচিত্র ‘ক্ষুদ্র ঋণের জালে’ এবং বাংলাদেশে প্রকাশিত নানা সংবাদে কিছু অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নো.ক. তাদের অবস্থান জানাচ্ছে : নোবেল পুরস্কার দেবার আগে যে ধরনের যাচাইবাছাই করা হয় ‘তার চেয়ে অনেক বেশি পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে’ গ্রামীণ ব্যাংক ও ইউনূসকে পুরস্কার দেবার আগে। ইউনূসকে নোবেল পুরস্কার দেয়া নিয়ে প্রামাণ্যচিত্রে কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত না হলেও বা এ নিয়ে কারো কোনো সংশয়-উৎকণ্ঠা প্রকাশের আগেই ‘ঠাকুর ঘরে কে রে? আমি তো কলা খাইনি’ ধারায় নো.ক. অগ্রিম আশ্বস্ত করেছে সবাইকে। কিন্তু, বিবৃতিটির একটি লাইন উদ্বিগ্ন ও কৌতূহলী করে তুলবে এর উদ্দেশ্য ও নৈতিক মানদণ্ড নিয়ে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে ‘যখন একটি ব্যাংকের ৭০ থেকে ৮০ লাখ ঋণগ্রহীতা থাকে, তখন তার মধ্যে কিছু নেতিবাচক উদাহরণ পাওয়া যেতে পারে।’ এই বাক্যটির মধ্যে গুরুতর ও ভয়ানক কয়েকটি দিক রয়েছে : ১. নো.ক. প্রকারন্তরে স্বীকার করছে যে ‘কিছু নেতিবাচক উদাহরণ’ আছে ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষেত্রে । সেক্ষেত্রে তাদের ‘অনেক বেশি পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত নেয়া’র ফল কী দাঁড়ালো? তারা অনিয়ম জর্জরিত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কৃত করে কি বিশ্ববাসীকে ধোঁকা দিল? ২. তাদের কথায় মনে হচ্ছে নেতিবাচক উদাহরণের দায়দায়িত্ব যেন ৭০-৮০ লাখ দরিদ্র ঋণগ্রহীতার। কিন্তু, বৈদেশিক সাহায্য নিয়ে যে অনিয়মের অভিযোগ প্রামাণ্যচিত্রে এবং পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের সাংবাদমাধ্যমে এসেছে (নিজ পারিবারের ব্যবসার সাথে গ্রামীণ প্রধানের ব্যবসায়িক চুক্তি করা ও ঋণ দেয়াসহ অন্যান্য অনিয়ম) তার দায়দায়িত্ব কী দরিদ্র ঋণগ্রহীতাদের, নাকি ইউনূসসহ গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনাকারীদের? যাচাই-বাছাই করার সময় তারা কি তত্ত্বাবধানকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিট রিপোর্ট এবং সংশ্লিষ্ট দাতাসংস্থাগুলোর দলিলপত্র দেখেছিলেন? যদি দেখে থাকেন, তবে তাদের দেশের মহাফেজখানায় রক্ষিত ‘কনফিডেন্সিয়াল’ ছাপমারা দলিলদস্তাবেজের ভিত্তিতে আনীত অভিযোগের হদিশ নো.ক. কেন পেল না? নরওয়ের করদাতাদের অর্থ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা একটি ব্যক্তিকে তারা কী দেখে এই খেতাবে ভূষিত করল? নিজ দেশের মানুষের প্রতি নো.ক.র দায়বদ্ধতার যেখানে এই হাল, সেখানে বাংলাদেশের মানুষের প্রতি তারা কতটুকু শ্রদ্ধা ও দায়বদ্ধতা থেকে এই বিবৃতি দিচ্ছে সে প্রশ্ন তোলা কি যুক্তিসঙ্গত নয়? ৩. এই সাফাইমূলক বিবৃতি দেবার মাধ্যমে নো.ক. আসলে বাংলাদেশ সরকারের তদন্ত প্রক্রিয়াকে এবং সাধারণ জনগণকে বিভ্রান্ত করতে জড়িয়ে পড়েছে বলে যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত টেনে বলা যায় তারা নিজেদের ব্যর্থতা বা পরিকল্পিত ভূমিকা ঢাকতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেছে।
বিগত কয়েক মাসে ড. ইউনূসের মর্যাদা রক্ষায় আস্তে-আস্তে মঞ্চে হাজির হতে থাকে দেশের ভিতরের ও বাইরের আরো অনেক কুশীলবরা। বাংলাদেশের মানুষ আর সরকারকে দুর্নীতি দমনে পরামর্শদাতা বিশ্বব্যাংকসহ কিছু বিদেশী দূতাবাস বিশেষভাবে তৎপর হয়ে ওঠে সরকারের উপর চাপ প্রয়োগে। শেখ হাসিনাকে হিলারি ক্লিন্টন ফোন করেন ইউনূসকে রক্ষার জন্য। অন্যতম নেতৃস্থানীয় ও ব্যয়বহুল জনসংযোগ ও লবিস্ট ফার্ম বার্সন-মারসটেলরকে নিয়োগ দেয়া হয় আন্তর্জাতিক প্রচারণা ও লবি করার জন্য। এদের উদ্যোগে আয়ারল্যান্ডের সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান মেরি রবিনসনের নেতৃত্বে ‘ফ্রেন্ডস অফ ইউনূস’ নামের সংগঠন গড়ে ওঠে মুহাম্মদ ইউনূস এর মর্যাদা রক্ষার জন্য। অন্যদিকে ইউনূসকে কেলেঙ্কারি, তদন্ত আর বরখাস্ত হবার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য বিরামহীন তৎপরতা চলতে থাকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে।
মার্চ মাসের প্রথমাংশে বাংলাদেশ ব্যাংক ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে অপসারিত করার পর ইউনূসকে রক্ষার জন্য বিশেষ করে মার্কিন তৎপরতা এক অভূতপূর্ব নবমাত্রা লাভ করে। অপসারণের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রথমে ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত তার দেশের পক্ষ থেকে আপত্তিকরভাবে প্রচণ্ড ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ইউনূসকে রক্ষার বিষয়ে মার্কিন তৎপরতা এখানেই থেমে থাকেনি। একক ও যৌথভাবে মার্কিন সিনেটর ও কংগ্রেস সদস্যরা ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন বাংলাদেশের উপর। মার্চ মাসের শেষাংশে এই চাপ প্রয়োগ প্রকাশ্য হুমকিতে রূপ নেয় আমেরিকার দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফরকালে এবং তৎপরবর্তী সময়ে মার্কিন কংগ্রেসে দেয়া বক্তব্যের মাধ্যমে।
পুঁজিবাদী দুনিয়ার গণমাধ্যম ও কর্তাব্যক্তিদের প্রায় চার মাসাধিককাল ধরে চলমান এই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাই ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে কেন্দ্র করে একমাত্র বিরল ও অতুলনীয় ঘটনা নয়। ইউনূসকে কেন্দ্র করে বরাবরই বিরাজ করেছে অতুলনীয়, বিরল ও অভূতপূর্ব সব প্রবণতা ও প্রপঞ্চ। বিগত প্রায় আড়াই দশক ধরে খ্যাত-অখ্যাত নানা প্রতিষ্ঠান থেকে (ভেনেজুয়েলার সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মানসহ। হুগো চাভেজও ইউনূসের মর্মার্থ বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন।) শতাধিক পদক, খেতাব ও ডিগ্রী পেয়ে এক বিশ্ব রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন তিনি। সারা বিশ্বের সংবাদমাধ্যম ও মূলধারা উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা সর্বদা তাঁকে নিয়ে ব্যস্ত। এসবের মাধ্যমে অতিযত্নে তাঁকে পরিণত করা হয়েছে বিশ্ব আইকন হিসেবে। অর্থাৎ, তাঁর ব্যক্তি ইমেজের মাধ্যমে ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে দারিদ্র্যকে ইতিহাসে পরিণত করার এক কল্পকাহিনীকে বিশ্বাস করানোর মহাযজ্ঞ ঘটানো হয়েছে বিগত দু’ দশকেরও বেশি সময় ধরে।
গত শতাব্দীর ৬০ এর দশকে ‘সবুজ বিপ্লব’ এর স্বর্ণযুসহ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধত্তোরকাল থেকে আর কোনো বুর্জোয়া উন্নয়ন-পন্থা নিয়ে এত ঢাকঢোল পেটানো হয়নি; যা করা হয়েছে মু. ইউনূস প্রবর্তিত ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে। ক্ষুদ্রঋণ নামক এই উন্নয়ন-পন্থা নিয়ে এত ব্যাপক উৎসাহের কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে এটি প্রবর্তিত হবার সময়ের বৈশিষ্ট্য (স্মতর্ব্য ৮০র দশক থেকে নয়া-উদারবাদের ক্রম উত্থান); এ পন্থার মধ্যে লাভজনকভাবে দরিদ্রদের কাছে পুঁজি লগ্নী করার ক্রম প্রকাশ্য সম্ভাবনা এবং সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার অবসানকালে তৃতীয় বিশ্বে উন্নত দেশগুলোর উন্নয়ন সাহায্য নীতিকাঠামোর ক্রমশ নয়া-উদারবাদী পন্থার দিকে সরে যাবার ক্ষেত্র প্রস্তুতের সহায়ক হিসেবে এর ভূমিকা এই উন্নয়ন-পন্থাকে পুঁজিবাদী বিশ্বে জনপ্রিয় ও তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছিল। সব দিক থেকে ক্ষুদ্রঋণ হয়ে উঠেছিল একটি আদর্শ পুঁজিবাদী উন্নয়ন-পন্থা -- উন্নত বিশ্বের নয়নের মণি। এর মতাদর্শগত দিকটিও ছিল নয়া-উদারবাদের সঙ্গে যুতসইভাবে সঙ্গতিপূর্ণ; অবয়বে ছিল চোখে তাক লাগানো দরিদপ্রেমী চটক। সব মিলিয়ে এটি ছিল ‘ইতিহাসের অবসানে’র যুগে মানবিক চেহারাসম্পন্ন একটি আদর্শ পুঁজিবাদী উন্নয়ন-পণ্য।
বহুল বিক্রিত সেই লাভজনক উন্নয়ন-পণ্যটির কার্যকারিতা ও গুণাগুণ আজ যখন ক্রমশ প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে উঠছিল, সেই ধীরগতির প্রক্রিয়ায় বর্তমান ইউনূসকাণ্ড নানা দিক থেকে একটি বড় গতি সঞ্চার করেছে। প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে এই উন্নয়ন-পন্থার কার্যকারিতা ও অন্তঃসারশূণ্যতাকে। অন্তঃসারশূণ্য উন্নয়ন-পণ্যের মুখের মেকি রঙ যখন খসে পড়ছে, তখন বিব্রত হয়ে পড়ছে এই নাটকের প্রকৃত রূপসজ্জাকাররা। কাজেই মুহাম্মদ ইউনূসের ব্যক্তিগত সম্মান নিয়ে এই রূপসজ্জাকার হইচই তুললেও, আসলে তারা বিব্রত হচ্ছে নিজেদের উন্নয়ন-পন্থাটির আসন্ন মুখ থুবড়ে পড়া নিয়ে। ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে দারিদ্র্যকে জাদুঘরে পাঠাবার বাগাড়ম্বরের আশু ব্যর্থতার আশংকায় আর নিজেদের ইজ্জতহানী নিয়েই প্রকৃতপক্ষে তাদের এত উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা।
সহায়ক সূত্র:
১. ‘মাইক্রো-ফাইন্যান্স ইন্ড্রাস্টি ‘ব্লাড সাকারস’ এনকাউন্টার গ্লোবাল হোস্টিলিটি’। ইকোনমি ওয়াচ। ১.২.১১
২. ‘ওয়ার্ল্ড ব্যাংক : ফুড প্রাইসেস এ্যাট ‘ডেঞ্জারাস লেভেল’’। সিবিএস বিজনেস নিউজ। ১৫.২.১১
৩. ‘অ্যাজ ফুড প্রাইস রাইজ, সাসটেইনিবিলিটি মেকস মোর সেন্স’। দি ডেইলি স্টার। ওয়ানওনটা, নিউ ইয়র্ক।২৬.২.১১
৪. ‘মাইক্রো ক্রেডিট ক্রিটিকস সে ডেট ডাজনট ইকোয়াল ইমানসিপেশন’। কানাইয়া ডি’আলমেইদা। আইপিএস নিউজ। ২৪.২.১১
৫. স্টেট অফ দি মাইক্রোক্রেডিট সামিট ক্যাম্পেইন রিপোর্ট। মার্চ ২০১১
----------------------
নিবন্ধটি 'সংস্কৃতি' (এপ্রিল ২০১১) পত্রিকাতে প্রকাশিতশনিবার, ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০১১
দারিদ্র্যের বদলে মুহাম্মদ ইউনূসই কি জাদুঘরে ঠাঁই নিতে চলেছেন?
Muhammad Yunus
গ্রামীণ ব্যাংক ও এর প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ ইউনূসকে ২০০৬ সালে যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রদান করার বিষয়ে বাংলাদেশ, ভারত ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে হাতেগোনা যে কয়টি সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ ছাপা হয়েছিল ‘অনীক’ এ প্রকাশিত প্রতিবেদনটি (ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং পুরস্কারের রাজনীতি। নভেম্বর ২০০৬) ছিল তার মধ্যে অন্যতম। তখন এমন ধারণা ছিল যে, ক্ষুদ্র ঋণ বিষয়টি অনেকটাই বাংলাদেশ বা এনজিও-প্রবণ দেশের বিষয়। ভারতে এ নিয়ে চিন্তিত হবার বা আলোচনা করার কিছু নেই। সেসময় অনেকেই বুঝে উঠতে পারেননি যে, চার বছরের মধ্যে মুহাম্মদ ইউনূস কথিত ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে দারিদ্র্যকে জাদুঘরে প্রেরণ প্রক্রিয়ার অন্যতম শিকার বা উদাহরণ হয়ে উঠবে ভারত। বিগত দু’ দশকে ভারতে ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী ৩,০০০ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যার মধ্যে বর্তমানে সক্রিয় আছে ৪০০টি। সেটিও বড় কোনো তথ্য নয়; গত বছরের মার্চ থেকে নভেম্বরের মধ্যে অন্ধ্র প্রদেশে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর জুলুমে ৮০ জন দরিদ্র নারী-পুরুষ আত্মহত্যা করার পর সারা ভারত নড়েচড়ে ওঠে। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে চলতি আলোচনায় বিশেষ কয়েকটি দেশের সঙ্গে১ ভারতের নাম বারবার উঠে আসছে শুধু দরিদ্র ঋণগ্রহীতাদের আত্মহননের কারণে নয়; পুঁজির চরিত্র বুঝতে অক্ষম (?) এই অর্থনীতিবিদ একদা বৈদেশিক সাহায্য দিয়ে শুরু হওয়া ঋণ কার্যক্রমকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে এবং তা দিয়ে বহুজাতিক কোম্পানির পুঁজি-পণ্য-সেবার বাজারের পরিধি বিস্তারের জন্য লগ্নীকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্ষুদ্রঋণ খাতে বিনিয়োগ করার যে রাস্তা চিনিয়েছিলেন তার একটি বড় ফল আজ ভারতের দরিদ্ররা হাতেনাতে ভোগ করছে আর সেখানকার অবস্থাসম্পন্নরা ‘দারিদ্র্য বাণিজ্যে’র মুনাফা লুটছে শেয়ারে টাকা খাটিয়ে। ক্ষুদ্রঋণের ক্ষেত্রে ভারতের খ্যাতিমান হয়ে ওঠার এটিও একটি কারণ। গত বছর অগাস্ট মাসে ইউনূসের বিশেষ বন্ধু বিক্রম আকুলা ভারতে তার এস.কে.এস. মাইক্রোফাইন্যান্স প্রতিষ্ঠানের জন্য ১৬৩০ কোটি রূপি সংগ্রহ করেন ৯৮৫ রূপি দামের শেয়ার ছেড়ে। এক মাসের মধ্যে প্রতিটি শেয়ারের দাম ১৪০৫ রূপিতে উঠে গেলেও আত্মহত্যা কেলেঙ্কারির কারণে সরকারি বিধিনিষেধ জারির ফলে ডিসেম্বর মাসে শেয়ারের দাম দাঁড়ায় ৬৫৩ রূপিতে। ক্ষুদ্রঋণের সঙ্গে ভারতের প্রাসঙ্গিকতার সূত্রে তথ্যগুলো দেয়া হলো এবং এ থেকে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে কিছু বৈশ্বিক ধারাও অনুধাবন করা সম্ভব হবে। যদিও সম্প্রতি ইউনূস ক্ষুদ্রঋণের অনেক কিছু নিয়ে আপাত দ্বিমত প্রকাশ করছেন কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নেই যে এই বৈশ্বিক ধারা তাঁর হাতেই রচিত হয়েছে। এই দ্বিমত পোষণ হয় অসত্য ভাষণ অথবা পুঁজির মৌল চরিত্র সম্পর্কে তাঁর অর্বাচীন চিন্তাভাবনারই প্রকাশ, স্থানাভাবে যা নিয়ে এখানে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ থাকছে না।
নীরেনবাবুর শিশুর প্রশ্ন ‘... রাজা তোমার কাপড় কোথায়?’
সর্বাধিকসংখ্যক পুরস্কারে ভূষিত ইউনূস বিশ্বপর্যায়ের একজন কুশীলব। ‘গরিবের ব্যাংকওলা’ হিসেবে খ্যাতি থাকলেও তাঁর ওঠাবসার পরিধি কয়েক দশক ধরেই রাজদরবার আর কর্পোরেট হেডকোয়ার্টারে। ক্ষুদ্রঋণকে বিপথে চালিত করার জন্য যাদের দিকে তিনি আঙ্গুল দেখাচ্ছেন তারা সবাই দারিদ্র্য বিমোচনে আজও তাঁর সাঙাত। এখন অবশ্য তিনি আর ক্ষুদ্রঋণের মধ্যে নিজেকে আটকে রাখছেন না। দারিদ্র্যকে জাদুঘরে পাঠাবার জন্য এখন তাঁর মুখে ‘সামাজিক ব্যবসা’ নামের নতুন মন্ত্র। সেই সামাজিক ব্যবসার সাথী হয়েছে বিশ্বের বড়-বড় সব কোম্পানি--ফ্রান্সের ড্যানোন (খাদ্য), ভিওলিয়া (পানীয়জল) ও আইডি গ্রুপ (পোশাক); জার্মানির অ্যাডিডাস (জুতা), জাপানের ইউকিগুনি (কৃষিপ্রযুক্তি), ইউনিকলো (তৈরি পোশাক); আর যথারীতি আছে সংবাদমাধ্যম, নামীদামী পণ্ডিত এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়। বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিমধ্যেই খোলা হয়েছে সামাজিক ব্যবসা সংক্রান্ত নতুন কোর্স, কর্মসূচি ও গবেষণাগার। অতি সম্প্রতি তাঁর ভাবমূর্তিতে ধস নামা সত্ত্বেও এখনও তিনি বিশ্বমঞ্চে পাদপ্রদীপের আলোতে আছেন। আর নীরব কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলাদেশে তো কথাই নেই। নীরব ব্যতিক্রম বলার কারণ হচ্ছে নোবেল পুরস্কার পাবার পর বাংলাদেশে তাঁর জনপ্রিয়তা হয়েছিল আকাশচুম্বী। কিন্তু দেবতার সেই আসন টলতে শুরু করেছিল ২০০৭ সাল থেকে। ভারতে বোঝার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা তো ছিলই; এমনকী বাংলাদেশেও ২০০৬ সালে এটা অনেকেই বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলেন যে, বিশেষ করে ওই বছর ইউনূসকে নোবেল পুরস্কার দেবার পেছনে বাংলাদেশে সাম্রাজ্যবাদী রাজনৈতিক পরিকল্পনা কায়েমের একটি বড় সম্পর্ক ছিল। স্বরূপে জাজ্জ্বল্যমান হবার আগেই বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা হাজির করেছিলেন বদরুদ্দীন উমর তাঁর রাজনৈতিক বিশ্লেষণে২ এবং পরবর্তী ঘটনাবলি এসব বিশ্লেষণকে সঠিক বলেই প্রমাণ করেছে। তাঁর রাজনৈতিক চেহারা উন্মোচিত হওয়া শুরু হলে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে তরুণরা সন্দিহান ও বীতশ্রদ্ধ হওয়া শুরু করে এবং তাঁর ব্যাপারে কিয়দংশে মোহমুক্তি ঘটা শুরু হয় সচেতন অংশের মধ্যে।
বাংলাদেশসহ বিশ্বপর্যায়ে ইউনূস প্রচারমাধ্যমে প্রশ্নাতীত প্রচার সুবিধা ভোগ করে থাকেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এর দুটি কারণ রয়েছে : ১. এনজিও, সাম্রাজ্যবাদী বিভিন্ন চক্রান্ত, ক্ষুদ্রঋণ ইত্যাদি বিষয়ে সংবাদমাধ্যম প্রধানত সহায়ক ভূমিকা পালন করে এবং মূলধারার মুখপাত্র হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে চ্যালেঞ্জকারী মতামতকে উপেক্ষা করার ক্ষেত্রেও সক্রিয় ভূমিকা রাখে। ২. বাংলাদেশে বিজ্ঞাপনের অন্যতম বড় উৎস হচ্ছে মোবাইল ফোন কোম্পানি; যার মধ্যে আবার সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ফোনের মালিক গ্রামীণ ব্যাংক। এই দুই কারণে স্থানীয় সংবাদমাধ্যম ক্ষুদ্রঋণ, গ্রামীণ ব্যাংক ও ইউনূসের ব্যাপারে সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত নীরব ভূমিকা পালন করে আসছিল। একই কথা ভিন্নভাবে প্রযোজ্য এখানকার বুদ্ধিজীবীদের ব্যাপারে। এরা অধিকাংশই এনজিও ও বিদেশী দাতাসংস্থার বেতনভূক কনসালট্যান্ট হবার সুবাদে প্রকাশ্যে এমন কোনো মত প্রকাশ করেন না যাতে করে তারা মোটা পারিতোষিক প্রদানকারীর বিরাগভাজন হতে পারেন। সেজন্য বাংলাদেশ জুড়ে ইউনূস বিষয়ে রয়েছে অভূতপূর্ব নীরবতা। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় যে, গ্রামীণ ফোনের সিংহভাগের মালিক নরওয়ের টেলিনর এর বাংলাদেশে কাজের ক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিরাপত্তাজনিত বিষয়ে গুরুতর কেলেঙ্কারি (অ্যাসিডের চৌবাচ্চায় শিশু শ্রমিক পড়ে যাওয়া, বিলবোর্ড লাগাতে গিয়ে শ্রমিক নিহত হওয়া প্রভৃতি) নিয়ে ডেনিশ সাংবাদিক টম হাইনম্যান-এর ‘এ টাওয়ার আব প্রমিজেস’৩ প্রামাণ্যচিত্রে ২০০৮ সালের মে মাসে প্রচারের ফলে সারা দুনিয়ায় হইচই সৃষ্টি হয়ে টেলিনরের প্রধান নির্বাহীর চাকরি যাবার উপক্রম হলেও, বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম এ বিষয়ে নীরব থাকে।৪ অবশেষে, এই অবস্থায় একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে যায় গত ৩০ নভেম্বর নরওয়ের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন এনআরকে-তে প্রচারিত টম হাইনম্যানের ‘কট ইন মাইক্রো ডেট’৫ নামের নতুন প্রামাণ্যচিত্রকে কেন্দ্র করে। টমের প্রামাণ্যচিত্রটি প্রচার হবার পর হঠাৎ করে বাংলাদেশসহ বিশ্ববাসীও যেন দেখতে পায় তাদের রাজা উলঙ্গ!
দারিদ্র্য জাদুঘরের অবস্থা
ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে দারিদ্র্যকে জাদুঘরে পাঠাবার বিশ্বপর্যায়ের ধাপ্পাবাজি নিয়ে বাংলাদেশে শক্তিশালী সমালোচনা ছিল বদরুদ্দীন উমর, আনু মুহাম্মদ, ফারুক চৌধুরী প্রমুখের। সাম্প্রতিক সময়ের আগেই বরং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তেমন কোনো সমালোচনা খুব একটা ছিল না। সম্প্রতি এই অবস্থা পাল্টাতে শুরু করেছে। অনুসন্ধানী সাংবাদিক টমের প্রামাণ্যচিত্রটি এ ক্ষেত্রে অবস্থার মোড় ঘুড়িয়ে দিয়েছে জোরালোভাবে--বাংলাদেশ এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। এই প্রতিবেদন ছাপাখানায় যাবার আগে (১৫.১.১১) ইউনূসের বন্ধু হিলারি ক্নিনটন শেখ হাসিনাকে ফোন করেছিলেন রাষ্ট্রীয় কাজে; কিন্তু পর্যবেকদের অনুমান ফোন করার আসল কারণ ইউনূসকে রক্ষা করার তদবির করতে। প্রামাণ্যচিত্রে টম দুটি বিষয় তুলে ধরেছেন। টমের ভাষ্যে ‘আমাদরে প্রামাণ্যচত্রিরে মূল বক্তব্য: ক্ষুদ্রঋণ সত্যি দারদ্র্যি দূর করে? গরীবরে হাতে একটা ক্ষুদ্র অংকের টাকা দেওয়া এবং বাকি কাজটুকু ‘বাজারকে’ করতে দেওয়াই কি দারদ্র্যি দূর করা? মেক্সিকো, ভারত ও বাংলাদশেরে অসংখ্য দরদ্রি মানুষরে সঙ্গে কথা বলার পর আমার তা মনে হয় না। ... আমার জানা মতে, এবারই প্রথম কোনো টেলিভিশিন-প্রামাণ্যচত্রি ভিন্ন দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়েছে, দেখাতে চেয়েছে মুদ্রার উল্টো পিঠ।’
এর পাশাপাশি টম নরওয়ের বৈদেশিক সাহায্য সংস্থা নোরাডের মহাফেজখানায় ‘গোপনীয়’ হিসেবে চিহ্নিত নথিপত্র ঘেঁটে বৈদেশিক সাহায্যের টাকা নিয়ে ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের অনিয়ম করার বিষয়টি উদঘাটন করে দেখান যে, ‘দারদ্র্যি দূর করার জন্য র্ভতুকি হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংককে ১৯৯৬ সালে দেয়া বিপুল অর্থ থেকে ১০ কোটি ডলাররেও বেশি ‘গ্রামীণ ব্যাংক’ থেকে ‘গ্রামীণ কল্যাণ’ নামে নিজের অন্য এক প্রতষ্ঠিনে সরিয়ে নেন ইউনূস। ১০ কোটি ডলাররে মধ্যে সাত কোটি ডলাররেও বেশি অর্থ ‘গ্রামীণ কল্যাণ’ নামরে প্রতিষ্ঠানেই থেকে যায়। এরপর গ্রামীণ কল্যাণরে কাছ থেকে ওই অর্থ ঋণ হিসেবে নেয় গ্রামীণ ব্যাংক। বৈদিশিক সাহায্যরে অর্থ নিয়ে অনিয়মের ঘটনা গোপন রাখার বিষয়ে নোরাডরে তখনকার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে ১৯৯৮ সালরে ১ এপ্রিল লেখা চিঠিতে ইউনূস বলনে, “আপনার সাহায্য দরকার আমার। সরকার এবং সরকারের বাইরের মানুষ বিষয়টি জানতে পারলে আমাদের সত্যিই সমস্যা হব।”
যে কেলেঙ্কারির শেষ নেই
টমের প্রামাণ্যচিত্রটি প্রচারের পরপরই এই টেলিভিশন চ্যানেলটির নিজস্ব প্রতিবেদকের আরেকটি প্রামাণ্যচিত্র প্রচারিত হয় গ্রামীণ ফোন নিয়ে ইউনূসের প্রতারণামূলক মিথ্যাগল্পের উপর। এছাড়াও বাংলাদেশী সাংবাদিকদের অনুসন্ধানে আরো কয়েকটি গুরুতর ঘটনা উদঘাটিত হয়েছে ইউনূসের কেলেঙ্কারি নিয়ে; যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বাবা ও তিন ভ্রাতার সাথে তার নিজস্ব মালিকানার একটি প্রেস ও প্যাকেজিং কোম্পানির সঙ্গে গ্রামীণ ব্যাংকের পক্ষে তাঁর নিজের করা ব্যবসায়িক চুক্তি ও এই প্রতিষ্ঠানকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে তিন কোটি টাকা ঋণ দেয়া বিষয়ে।৬
দারিদ্র্য জাদুঘরের একমাত্র দর্শনীয় বস্তু
এসব কদর্য কেলেঙ্কারি দেখে সঙ্গতভাবে অনুমান করা যায় যে, গত কয়েক দশক ধরে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বে যে অতিকথা গড়ে তোলা হয়েছিল সেই ‘পভার্টিস্ট্রীট’ও মনে হয় ওয়ালস্ট্রীটের লজ্জাজনক কেলেঙ্কারির রাস্তা ধরে বিশ্বমঞ্চ থেকে প্রস্থানের পথে পা বাড়িয়েছে। আর ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবী থেকে দারিদ্র্যকে জাদুঘরের দর্শনীয় বস্তু হিসেবে পরিণত করার ঘোষণা দিয়ে বিশ্বরঙ্গমঞ্চ দাপিয়ে বেড়ানো এবং দুনিয়ে জুড়ে দরিদ্র মানুষের সাথে মশকরাকারী ‘গরিবের ব্যাংকওলা’ মুহাম্মদ ইউনূস দারিদ্র্যের বদলে নিজেই হয়তো জাদুঘরে ঠাঁই নেবেন ‘দ্য ম্যান হু সোল্ড আইফেল টাওয়ার’ হিসেবে পরিচিত ভিক্টর লাস্টিং এর মতো কুখ্যাত ভাঁওতাবাজদরে সারিতে।
নোট:
১. আমেরিকান এনজিও কেয়ার ১৯৯৭ সালে ৩৫ লাখ ডলার (যার মধ্যে মার্কিন সরকারের বা জনসাধারণের অর্থ ছিল ৪৫০,০০০)দিয়ে পেরুতে ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম চালু করেছিল। ২০০৯ সালের শেষ দিকে পেরুর বৃহত্তম ব্যাংক ব্যাঙ্কো দি ক্রেদিতো এই কার্যক্রমটি ৯,৬,০০০,০০০ ডলার দিয়ে কিনে নেয়। এই অর্থ থেকে কেয়ার নগদ ৭,৪,০০০,০০০ লাখ ডলার মুনাফা নিয়ে ফেরত যায় আমেরিকাতে। মেক্সিকো তে ক্রীমোস ক্ষুদ্র ঋণের জন্য আদায় করে বার্ষিক ১২৫% সুদ। কমপার্টামোস নামের সেখানকার আরেক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান আদায় করে ৮০% সুদ। নিকারাগুয়ায ৩৫% সুদ আদায় হয় বলে দানিয়েল ওর্তেগা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এবং ঋণগ্রস্তদের ঋণ পরিশোধ না করার আন্দোলনকে সমর্থন জানিযেছেন। ল্যাপো নামে নাইজেরিয়ার একটি প্রতিষ্ঠান বার্ষিক ১২৬% সুদ আদায় করে। (নিউ ইয়র্ক টাইমস ১৩.৪.২০১০ এবং হনলুলু স্টার-অ্যাডভাইটাইজার ৬.১.২০১১)
২. ‘বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন ও নোবেল শান্তি পুরস্কার’ (১৬.১০২০০৬) এবং ‘রাজনৈতিক সংকট সমাধানের জন্য ইউনূসের প্রস্তাব’ (২১.১১.২০০৬)। ডক্টর ইউনূসের দারিদ্র্য বাণিজ্য বইতে অন্তর্ভুক্ত দুটি নিবন্ধ। সংস্কৃতি প্রকাশনী। ঢাকা। ২০০৬।
৩. http://tomheinemann.dk/a-tower-of-promises/
৪. www.aftenposten.no/english/business/article2422108.ece
www.aftenposten.no/english/business/article2434071.ece
৫ http://www.flipthecoin.org/?p=301
৬. http://ns.bdnews24.com/blog/en/index.php/bdnews24com/435
----------------
লেখাটি কলকাতা থেকে প্রকাশিত অনীক পত্রিকার আমন্ত্রণে লিখিত এবং জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ২০১১ যুগ্ম সংখ্যায় (কলকাতা বইমেলা) প্রকাশিত। ১৫.১.২০১১